অল্প নিদ্রা যখন ভয়ঙ্করী

বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত আমাদের ঘুম পাওয়ার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও এটি অবস্যই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে ঘুম আমাদের শরীর সুস্থ এবং সক্রিয় রাখার জন্যে একান্ত প্রয়োজনীয়। একজন সুস্থ ব্যক্তির দিনে ন্যূনতম ৮ ঘন্টা ঘুমের একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বিভিন্নরকম দৈনন্দিন কুঅভ্যাসের জন্যে অথবা কর্তব্য পালন বা ব্যস্ততার দরুন সেইভাবে ঘুমানো কোনো ভাবে সকলের সম্ভব হয়তো হয়ে ওঠেনা। এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা আছে যেখানে তাদের গোটা দিন জেগে থাকতে লাগে বা হয়তো খুবই অল্প সময় ঘুমিয়ে নিতে লাগে। আবার কাজের মাঝে অল্প ঘুমিয়ে নিলেও মুসকিল, ফাঁকিবাজ তকমা অথবা সৌভাগ্যের কারনে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভনা থেকে যায়। স্বল্পমেয়াদী ঘুমের ফলে মস্তিষ্কের বিচারশক্তি প্রভাবিত হয় , তথ্য মাথায় রাখার ক্ষমতা বাধাপ্রাপ্ত হয় , মানসিক চাপ সহ্য  করবার ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। সময়ের সাথে সাথে ঘুমের অভাবের ফলে কার্ডিওভাসকুলার রোগ, স্থূলত্ব এবং জ্ঞানীয় ক্রিয়াকলাপগুলি তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে যা মানুষকে তার সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতা অর্জন থেকে বঞ্চিত করে। আরো আশ্চৰ্য হবেন এই জেনে, যে পৃথিবীর অনেক ভয়ঙ্কর এবং সর্বনাশা বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পিছনে কারণ ছিল এই "অল্প নিদ্রা" মহাশয়। অল্প ঘুম দিয়ে কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবার চেষ্টা বৃথা, আর তার উদারহণ হিসাবে রইলো কিছু উদাহরণ স্বরূপ সত্য ঘটনা !


// Exxon Valdez-এর  তেল বিপর্যয় 
২৪ শে মার্চের ১৯৮৯ সালে তেল বহনকারী জাহাজ EXXON Valdez মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পরে। অসতর্ক ভাবে বিশাল তেলের জাহাজ গিয়ে ধাক্কা মারে সমুদ্রে থাকা প্রবাল প্রাচীরে গিয়ে । জাহাজে অবস্থিত কোনো ব্যক্তির কোনোরকম ক্ষতি না হলেও বিশাল তেল ট্যাঙ্কার থেকে কাঁচা তেল সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । প্রায় ১১০ লক্ষ গ্যালন তেল ছড়িয়ে পরেছিল আসেপাশের সমুদ্রেতটে যা কেড়ে নিয়েছিল হাজার হাজার সামুদ্রিক জীবের প্রাণ,মাইলের পর মাইল তেল ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র। EXXON Shipping Company এর আগেও নিপুণভাবে প্রায় ৮৭০০ বার তেল বহন করে নিয়েগিয়েছে বিগত ১২ বছর ধরে কিন্তু এমন ভয়ানক দুর্ঘটনা এর আগে বা পরে আর ঘটেনি। কর্তারা কিছুটা আশ্চর্য ও বিষ্মিত হয়ে তত্বাবধান চালাতে আদেশ দেন এবং তত্বাবধানের ফলস্বরূপ জানা যায় যে জাহাজের ক্যাপ্টেন জোসেফ হ্যাজেলউড এবং তার সহযোগী চালক বিগত ২ দিন ধরে ৬ ঘন্টার কম সময় পেয়েছিলেন ঘুমোনোর জন্যে যার ফলে তারা ছিলেন অত্যন্ত ক্লান্ত এবং নিদ্রামগ্ন। অজান্তেই তারা ঘটিয়ে ফেলে এই বিভৎস্য ঘটনা, ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কোটি কোটি টাকা এবং সামুদ্রিক প্রাণীজ সম্পদ দুইই । পৃথিবীতে ব্যয়বহুল সামুদ্রিক দুর্ঘটনার মধ্যে EXXON VALDEZ-এর তেল দুর্ঘটনা এখনো পর্যন্ত প্রথম স্থান গ্রহণ করে আছে।


// THREE MILE দ্বীপের ঘটনা 
২৮শে মার্চ, ১৯৭৯ সাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার একটি স্থানে,আনুমানিক ভোর ৪ টে নাগাদ  Three Mile Island পারমাণুবিক চুল্লিতে কিছু প্রযুক্তিগত বিকলতার খবর সেই পারমানবিক কেন্দ্রের কর্মচারীরা জানতে পারেন কিন্তু সঠিক কোন বিভাগে  সমস্যা তা ঠাহর করে উঠতে পারেননা। ফলে তারা মেরামত করতে গিয়ে ব্যাপার আরো গুরুতর হয়ে পরে। পারমানবিক চুল্লির বিকলতার কারনে বিকিরণ(radiation) চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। শেষমেশ পরিণতি খুবই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির রূপ নিয়েছিল যা পুরোপুরি নিরাময় করতে লাগে ১২ বছর এবং তা করতে খরচ হয় প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।  তাছাড়াও কাছাকাছি থাকা কয়েকশো জনগণ গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, অনেক জীবজন্তু এবং উদ্ভিদ নিমিষেই মারাযায়। যখন তদন্তকারীরা কাজে নামেন তখন পরমাণুবিক কেন্দ্রের কর্মচারীদের হওয়া ঘুমের বঞ্চনাকেই উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন।


//"THE CHALLENGER" বিস্ফোরণ 
 একটি মহাকাশযানকে মহাকাশে ঠিকভাবে প্রেরণ করা খুবই সময়, ব্যয় এবং নিদ্রাহীন শ্রম স্বাপেক্ষ। দলে থাকা প্রায় সকল বিজ্ঞানীদের এবং কর্মচারীদের অনেক নিদ্রাহীন দিন রাত কাটাতে হয়ে থাকে একটি সফল উৎক্ষেপণের জন্যে। ১৯৮৬ সালের ২৮ শে জানুয়ারিতে, ফ্লরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে "THE CHALLENGER" মহাকাশ উৎক্ষেপণ করা হয় কিন্তু উৎক্ষেপণের ৭৩ সেকেন্ড পরে সেটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বিস্ফোরিত হয়। এই দুর্ঘটনায় মারা যান "THE CHALLENGER" এ থাকা ৭ জন মহাকাশচারী।  পরবর্তীকালে, কম ঘুমের ফলে হওয়া দুর্বল বিচারকে এবং সিন্ধান্তকে দায়ী করে বৈজ্ঞানিক মহল। শীর্ষ পরিচালকরা আগের রাতে মাত্র কিছু ঘন্টা ঘুমাতে পেরেছিলেন যার জন্যে তাদের ভুলগুলি খুবই সহজে ঘটে পরে।  কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই ভুলের মাশুলটি খুবই ভয়াবহ পরিণতি নেয়।


// ভোপালের Gas leak দুর্ঘটনা
২রা ডিসেম্বর, ১৯৮৪ সালে ভোপালের (মধ্যপ্রদেশ, ভারতবর্ষ) বাসিন্দারা যখন রাতে নিয়মিতভাবে ঘুমাতে যাচ্ছেন তখন তাদের অনেকেই জানতেননা যে এইটাই তাদের জীবনের শেষ ঘুম হয়ে উঠবে। শহর নিদ্রামগ্ন থাকাকালীন, সেখানে অবস্থিত "ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড" -এর  কীটনাশক তৈরির কারখানা থেকে একটি storage tank leak হওয়া  শুরু করে। যান্ত্রিক বিকলতার দরুন এই সমস্যা হয়ে থাকে। ডিসেম্বর ৩ তারিখ, আনুমানিক রাত ১টা  নাগাদ ভীষণ গর্জনের সঙ্গে সেই ট্যাঁক ফেটে পরে এবং বাতাসে Methyl Isocyanate ছড়িয়ে পরে যার ফলে ৩৮০০ জন মানুষ তৎক্ষণাৎ মারা যান। মধ্যরাতের তন্দ্রাগত কর্মচারীদের ভুলের কারনে ঘটে এই ঘটনা সেটি পরবর্তীকালে তদন্তকারীরা জানতে পারেন। শেষপর্যন্ত জানা যায় যে এই ঘটনার কারনে প্রায় ১৫০০০ মানুষ  তাদের প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং প্রায় ৬ লক্ষেরও বেশি মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত বা দৃষ্টিশক্তি জনিত রোগে কষ্ট পেয়েছিলেন।


// Air France 447
১লা জুন ২০০৯ সালে, Air France Flight 447 নামক একটি দৈনিক যাত্রীবাহী বিমান, অন্যান্য দিনের মতন দক্ষিণ আমেরিকার রিও-দে-জেনেরিও থেকে প্যারিস শহরে পৌঁছোবার জন্যে সফরে বেরিয়েছিল। কিন্ত ৪ ঘন্টা পরে সেই বিমান কোনোরকম সাবধানবাণী না দিয়েই দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয় এবং বিমানের সমস্ত যাত্রীরা সেই দুর্ঘটনায় মারা যায়। বিমানের ক্যাপ্টেন এবং সহ পাইলট থাকা সত্ত্বেও এমন দুর্ঘটনা হবার কারন খুঁজতে প্রথমে একটু অবাক হতে হয়েছিল তদন্তকারীদের। পরে জানা যায় যে রিও-দে-জেনেরিও তে আসার পরে দুই সহ-পাইলট Pierre-Cedric Bonin আর  David Robert এবং ক্যাপ্টেন  Marc Dubois তিনদিন ভালো ভাবে বিশ্রাম নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্যারিস ফেরৎ যাবার আগের রাতে ক্যাপ্টেন মাত্র একঘন্টার বিশ্রাম নেন। তার সহ-পাইলটরাও তেমন বিশ্রাম নেন নি বলে জানা যায়। বিমান চালানোর প্রথম ৪ ঘন্টা খুব ভালোভাবে কেটে গিয়েছিলো সেই কারণে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই দেখে ক্যাপ্টেন সামান্য বিশ্রামের জন্যে ককপিটের পিছনে থাকা bunk এ গেলেন। কিন্তু কিছু সময়ে পরে, বিমান একদল বজ্রঝড়ের মধ্যে পরে যায়। সমস্তকিছু সামলে উঠতে গিয়ে পাইটলটরা প্লেনকে ৩৬০০০ ফুট থেকে ৩৮০০০ ফুট উচ্চতায় নিয়ে যান কিন্তু তারা দুইজনই "AUTO-Pilot" যে বিকল হয়ে পড়েছে তা খেয়াল করেননি । "AUTO-Pilot" ছাড়া প্লেন এক সময়ে নিচের দিকে মুখ করে ফেলে এবং মাত্র ৩-৪ মিনিটের মধ্যে ২২৮জন যাত্রীদের নিয়ে Air France 447 আটলান্টিক মহাসাগরে আছড়ে পরে। মিনিট কিছু আগে ককপিটে পৌঁছে ক্যাপ্টেন নিয়ন্ত্রণ সামলানোর চেষ্টা করতে চাইলেও পেরে ওঠেন না, ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
 এরকম আরো হাজারো ছোট বড় ঘটনা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও মূল যে বিষয়ে নিয়ে আজকের বক্তব্য শুরু, সেই ঘুম কিন্তু আজকের দিনেও ঠিক ভাবে দিতে পারেননা সমাজের বেশিরভাগ কর্মচারী বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক এবং পরিচালকগণ । আর কোনোদিনও যে ঠিকভাবে নিজেদের কাজ সম্পূর্ণ করে ভালো ঘুম দিতে পারবেন কিনা সেই প্রতিশ্রুতিও কেউ দিতে সাহস করেননা, এতটাই ব্যাতিব্যাস্ত হতে পছন্দ করে আজকালের মানুষ বা মনুষ্য দ্বারা চালিত সমাজ ।

Comments

Followers