চেক প্রজাতন্ত্রের(Czech Republic) কুটনা হোরা অঞ্চলে অবস্থিত প্রাচীন
সেডলেক চার্চ বা সেডলেক গির্জা(Sedlec Church) আন্তর্জাতিক ভ্রমণ পিপাসুদের একটি পরিচিত স্থান। কিন্তু এই স্থান দেখতে আসার আগে দর্শনার্থীদের রীতিমতো মনে অসীম সাহসের যোগান দিয়ে তবে আসতে হয় । কারন যে নির্দিষ্ট খ্রিস্টান গির্জার উদ্দেশ্যে দেশ বিদেশ থেকে প্রতি বছর, প্রায় ৪ লক্ষ্যের বেশি দর্শনার্থীরা এসে ভিড় জমান সেটির অনেক খানি অংশ সুসজ্জিত রয়েছে প্রায় ৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০ মানুষের হাড়ের দ্বারা। চার্চের বেসমেন্টে রাখা শুধুমাত্র মানুষের হাড়ের দ্বারা তৈরী ভিন্নরকমের প্রসাধন অলঙ্করণ দেখে দর্শনার্থীদের যত না ভীত হতে হয় তার থেকে বেশি আশ্চর্য হতে হয় শিল্পীর পরিকল্পনা দেখে। সিস্টারসিয়ান মঠ কর্তৃপক্ষরা আনুমানিক ১১৪২ সালে একটি সাধারণ খ্রিস্টান চার্চ হিসাবে এটি স্থাপন করেন।কথিত আছে যে ১২৭৮ সালে, একজন মঠাধ্যক্ষ
জেরুসালেমে তীর্থযাত্রা করতে গিয়ে প্রচুর পরিমানে মাটি সংগ্রহ করে আনেন পবিত্র
গোলগোথা থেকে।
গোলগোথা সেই স্থান যেখানে শ্রদ্ধেয়
যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। মঠাধ্যক্ষ তীর্থযাত্রা থেকে গির্জায় ফিরে এসে গির্জা-সংলঘ্ন কবরস্থানকে শোধন করবার উদ্দেশ্যে সেই সংগ্রহ করা পবিত্র মাটিকে সেখানে ছড়িয়ে দিলেন। খুবই শীঘ্রই সেডলেক গির্জার কবরস্থানটি স্থানীয় লোকেদের কাছে অত্যন্ত আকাঙ্খিত একটি পবিত্র কবরস্থান হিসাবে গণ্য হতে লাগলো।
|
Sedlec Church সৌজন্যে : Google |
পরবর্তীকালে ১৪ দশকে ঘটে যাওয়া Black Death মহামারী চলা কালীন প্রায় ৩০,০০০ এর বেশি মৃতদেহকে কবর দেওয়া হয়েছিল এই কবরখানায় এবং এর পরে ১৪১৯-১৪৩৪ সালে ঘটে যাওয়া Hussite যুদ্ধের সময়কালে আরো ১০,০০০ এর বেশি মৃতদেহের ঠাঁই পান এই সেডলেক চার্চ কবরখানাতে। কবরখানার নিয়ম অনুসারে মাটিতে কবর দেওয়া মৃতদেহটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে মাটি থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং অবশিষ্ট অস্থিঅবশেষকে গির্জায় অবস্থিত অস্থি সংরক্ষণাগারে (Ossuary) সঞ্চিত রাখা হয়।
প্রচুর পরিমান কবর দেওয়ার ফলে এক সময়ে সেডলেক গির্জার অস্থি সংরক্ষণাগারে জায়গার অভাব লক্ষ করতে শুরু করেন গির্জা কর্তৃপক্ষরা। আনুমানিক ১৯ দশক থেকে কর্তৃপক্ষরা অস্থি সংরক্ষণাগারের অতিরিক্ষ অস্থি দিয়ে গির্জার বিভিন্ন রকম প্রসাধন তৈরী করতে শুরু করেন। কিছু কিছু প্রসাধন তৈরির অন্তরালে আবার রয়েছে কিছু রোমাঞ্চকর কাহিনী। যেমন কথিত আছে যে কিছু সংখ্যক অর্ধ অন্ধ সন্ন্যাসীরা মিলিত হয়ে হাড় দিয়ে তৈরী করেছিলেন ৬টি পিরামিড যা বর্তমানে ৪ টি অবশিষ্ট রয়েছে। সেটি নির্মিত করবার পর অর্ধ দৃষ্টিহীন সন্ন্যাসীরা তাদের দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরো ফিরে পেতে সক্ষম হন। সেডলেক চার্চ এর বিশাল ঝাড়লণ্ঠন তৈরী করতে লেগেছে মানুষের শরীরের প্রায় সবরকম হাড়। প্রায় ৮ ফুটের এই ঝাড়লণ্ঠনদান তৈরী করেছিলেন František Rint নামক একজন চেক কাঠ ভাস্কর, ১৮৭০ সালে তাকে এই কাজে নিযুক্ত করেছিলেন Schwarzenbergs পরিবার । ঝাড়লণ্ঠন ছাড়াও রয়েছে সম্পূর্ণ হাড় দিয়ে নির্মিত বিত্তশালী Schwarzenbergs পরিবারবর্গের "coat of arms" এর নকশা যা দেখলে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়। গির্জা কর্তৃপক্ষদের এমন কার্যকলাপের কারণ ছিল তাদের একরকম বিশ্বাস। তারা মনে করতেন এমন হাড়ের দ্বারা তৈরী বস্তু যা ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে নির্মাণ করা হয়েছে , মৃত্যুর পরে সেই হাড়ের মালিকের সাথে ঈশ্বর একরকম পরলৌকিক যোগ সাধন করে, যা সেই ব্যক্তির আত্মাকে শান্ত করতে বিপুল সাহায্য করে থাকে। ২০১৪ সালে
সেডলেক অস্থি সংরক্ষণাগার সংস্কার এবং রক্ষনাবেক্ষন করা হয় এবং সম্পূর্ণ গির্জার কাঠামোকে পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালী করে রাখা হয়। বিশ্ববিখ্যাত সেই অস্থি ঝাড়লণ্ঠনকে পুনঃসংস্করণ করে রাখা হয় ২০১৬ সালে। সম্প্রতি ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারী মাসে আরো কিছু দরকারি সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়ে থাকলেও দর্শনার্থীরা সেই স্থানে আসতে পারবেন কোনো বাধা ছাড়াই।
Comments