মুক্তিপণ এবং জুলিয়াস সিজার

একবিংশ শতকে এসে "জুলিয়াস সিজার" কে চেনেন না এমন ব্যক্তি হয়তো খুব কমই আছেন। তার ব্যাপারে সবিস্তারে না জানলেও অন্তত তিনি যে একজন শক্তিশালী রোমান শাসক ছিলেন সেটা নিশ্চই জেনে থাকবেন। তাও যারা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল  নন তাদের সুবিধার্থে একটু সংক্ষেপে জানিয়ে দিই  যে একসময়ে রোমান রাজত্ব্যের একজন দুঃসাহসিক সেনা প্রধান, জ্ঞানী রাজনীতিবিদ, নামজাদা ল্যাটিন সাহিত্যিক এবং দূধর্ষ শাসক ছিলেন এই  গিয়াস জুলিয়াস সিজার ওরফে "শুধু" জুলিয়াস সিজার । খুবই অল্প বয়স থেকেই তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন যা পরবর্তীকালে তাকে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র শাসক হতে প্রচুর সাহায্য করে। তবে তিনি সত্যি যে একজন মহান শাসক হবার যোগ্যতা রাখেন সেই দৃষ্টান্ত জুলিয়াস সিজার নিজেই একদিন একটি ঘটনার দ্বারা সমগ্র রোমানবাসীদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ৭৫ BCE, আনুমানিক আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে, প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিক আপোলোনিয়াসের কাছে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ২৫ বছরের তরুণ সিজার রোম থেকে রহডসে সমুদ্র পথে রওনা দেন। এজিয়ান সাগরের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময়ে সিজারের ব্যক্তিগত জাহাজে কুখ্যাত সিলিসিয়ান জলদস্যুরা আক্রমণ করে এবং তরুণ সিজার সহ সমগ্র জাহাজকে অপহরণ করে নিয়ে যায় জলদস্যূদের একটি গুপ্ত দ্বীপে, তাদের নিজস্ব ডেরায় । তরুনের মুক্তিপণ হিসাবে জলদস্যুর সর্দার রুপোর ২০টি  ট্যালেন্ট দাবি করেন যা আজকের দিনে প্রায় ৬২০ কেজি রুপোর সমান, দাম সম্ভবত ৬০০,০০০ মার্কিন ডলার। সিজার নিজের মুক্তিপণ এতো কম চাওয়া হয়েছে দেখে হেসে পড়েন এবং  দস্যুসর্দারকে বলেন যে তিনি যেন অন্তত ৫০টি রুপোর ট্যালেন্ট সিজারের মুক্তিপণ হিসাবে দাবি রাখেন। যেমন প্রস্তাব জুলিয়াস সিজার দিলেন তেমনটাই কাজ হলো, সেই সময়ে ৫০টি রুপোর ট্যালেন্ট আজকের যুগে অন্তত ১৫৫০ কেজি রুপোর সমান। মুক্তিপণ আদায় করবার জন্যে জাহাজে থাকা সিজারের কিছু সহকারীরা দেশে ফিরে গেলেন এবং সেই মুক্তিপণের রাশি নিয়ে ফিরে এলেন ৩৮ দিনের মাথায়। মুক্তিপণ আনার প্রক্রিয়া চলাকালী, সিজার বহুল জলদস্যূদের মাঝে মুষ্টিমেয় কিছু সহচর এবং ভৃত্যের সাথে প্রায় নিঃসঙ্গ অসহায় অবস্থায় ছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি ভীত হয়ে নিজেকে সংকুচিত করে রাখেননি। জাহাজে থাকা ভয়ঙ্কর দানবসম বর্বর জলদস্যূদেরকে কোনোরূপ ভয় না পেয়ে তাদের সাথে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতনই আচরণ করতেন জুলিয়াস সিজার। ঘুম পেলে সিজার কাউর সাথে কোনো কথা বলতে পারবেননা এটিও তিনি পরিস্কার জানিয়ে দিতে কোনো দ্বিধা বোধ করেননি। জুলিয়াস সিজার দিনের বেশিরভাগটাই কবিতা রচনা, আবৃত্তি এবং বক্তৃতা লিখে সময় কাটাতেন আর সেগুলি দিনের শেষে খুবই উৎসাহের সাথে জলদস্যুদের কাছে আবৃত্তি করতেন। তরুণ সিজার জলদস্যুদের সঙ্গে থেকে তাদের নানারকম খেলাধুলো, দৈহিক কসরত এবং বিভিন্ন কার্যকলাপের অংশগ্রহন করে এমনভাবে জুড়ে থাকতেন যেন তিনি কোনো বন্দী নন, তাদেরই একজন দলনেতা। তার এমন ভাব ভঙ্গিমা দেখে দস্যুরাও তাকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করলেন এবং তাকে কোনো কিছুতে বাধা দিতেন না, সিজার তার জাহাজে অথবা যে দ্বীপে জাহাজটিকে আটকে রাখা হয়েছে সেই দস্যুদের গুপ্ত দ্বীপে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতেন। জুলিয়াস সিজার একসময়ে দস্যু বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে মুক্তিপণ প্রদানের পরে সে একদিন এই জলদস্যুদের খুঁজে বের করবেন এবং তাদেরকে ক্রুশবিদ্ধ করবেন, যদিও সেই সময়ে মিত্রতা এতটাই বেড়েছিল যে দস্যুরা সিজারের কথার তেমন গুরুত্ব বুঝতে পারেননি, ভেবেছিলেন যে তিনি নিছক মজা করছেন। মুক্তিপণ প্রদানের পাঠ চুকিয়ে দিয়ে সিজার আর তার জাহাজের সকল সদস্য সেই দস্যুদের ডেরা থেকে দেশে ফিরলেন এবং মিলেটাস থেকে  কিছুদিনের মধ্যে একটি ছোট সামরিক নৌবহর তৈরী করে নিয়ে হাজির হলেন সেই দস্যুদের দ্বীপে। সৌভাগ্যবশত সেই দস্যুদল তখন তাদের আস্তানা ছেড়ে যেতে না পারায় খুবই সহজে ধরা পরে সিজারের কাছে। সিজার তার মুক্তিপনের ৫০ ট্যালেন্ট উদ্ধার করলেন এবং সমস্ত জলদস্যুদের আটক করে নিয়ে গেলেন পারগামন এর কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে । সেখান থেকে তিনি তৎকালীন এশিয়ার proconsul মার্কস জুনিয়াসের কাছে যান এবং সেই সকল জলদস্যূদের যাতে মৃত্যুদণ্ড হয় সেই আবেদন দায়ের করেন। কিন্তু মার্কস জুনিয়াস মৃত্যুদন্ডে আপত্তি জানালেন এবং বন্দী জলদস্যুদের ক্রীতদাস হিসাবে ব্যবহার করতে প্রস্তাব দিলেন, সেই ক্রীতদাস বিক্রি করে তার লভ্যাংশ মার্কস নিজে রাখবেন এমনটাই মতলব করেছিলেন Proconsul। উপরতলার আদেশে অপ্রসন্ন সিজার ফিরে আসলেন পারগামনে এবং শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছে অনুসারে সমস্ত বন্দীদের ক্রুশবিদ্ধ করে তাদের মৃত্যুদন্ড সম্পাদন করলেন, একসময়ে বন্দি থাকাকালীন যেমনটা সিজার জলদস্যুদের জানিয়েছিলেন। 

Comments

Followers