দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেকেই দেখে থাকি যে কোনো দোকান বা কোনো ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান, সেটি দিনের শেষে বন্ধ করার সময় ছোট করে পুজো বা আরতি দিয়ে বন্ধ করে থাকেন, তাদের অগাধ বিশ্বাস অর্পণ করে দিয়ে যান নানা পূজনীয় দেব দেবীর কাছে যাতে সেই রাতের মতন বা দিনের মতন তাদের প্রতিষ্ঠানকে চুরি ডাকাতির হাত থেকে রক্ষে করা যায়। অনেকে সেই বিশ্বাসের ওপর আস্থা রেখে অনেক মূলধন ও দামি সামগ্রীও দোকানে রেখে নিঃশ্চিন্তে বাড়িতে ঘুমিয়ে নিতে পারেন। বিশ্বাসের শক্তি এমনি। কিন্তু যদি আমি বলি যে এসব কিছুই নয় ভারতবর্ষের একটি গ্রামের কাছে, যেখানকার বাসিন্দারা বিগত ৩৫০-৪০০ বছর যাবৎ তাদের দোকান, ঘর-বাড়ি এমন কি সরকারি দপ্তরেও দরজা ব্যবহার করেননা তাহলে হয়তো একটু আশ্চর্যই হবেন।মহারাষ্ট্র রাজ্যের শনি শিঙনাপুর নামক গ্রামে এমনটাই রীতি চলে আসছে কয়েকশো বছর ধরে। শনি দেব এই গ্রাম কে চুরি ডাকাতির হাত থেকে রক্ষা করে আসছেন নিয়মিত ভাবেই।
|
দরজা-বিহীন বাসস্থান |
আশ্চর্যভাবে গ্রামের কোনো বাড়িতে কোনো দরজা লাগানোর প্রয়োজনীয়তা পরেনি, তালাও চড়েনি সিন্দুকে, পাশের বাড়ি কোথাও গেলেও বাড়ি অনায়াসে খোলা অবস্থাতেই রেখে যান, প্রতিবেশীদের কিছু অনুরোধ করেননা এবং বিগত কয়েক শত বছরে এমন কোনো অসৎ ব্যক্তির সাহস হয়নি যে শনি দেবতার নজরদারীতে কোনো চুরি বা এমনি কিছু একটা করে উঠবে। কথিত আছে, যদি কেউ কোনোদিন এমন কাজ করার চেষ্টা করে ফলস্স্বরূপ তার দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেবে শনিদেব এবং অন্য অসৎ কর্মের ফল হবে সাড়ে সাত বছরের দুর্ভাগ্য। যদিও কিছু বাড়িতে কাঠের প্যানেল লাগানো থাকে তবে সেটি দেওয়া হয় যাতে বাইরের নেড়ি কুকুর ঘরে অনায়াসে প্রবেশ না করতে পারে। ২০১১ সালে যখন UCO Bank এই শনি শিঙনাপুর একটি শাখা খোলে সেটি ভারতের সর্বপ্রথম "তালাবিহীন" শাখা হিসাবে গণ্য হয়। ২০১৫ সালে খোলা আঞ্চলিক পুলিশ থানাতেও এখনো পর্যন্ত একটি নালিশ জমা পড়েনি গ্রামবাসীর তরফ থেকে। এবার চলে আসি সেই লোককথার কাছে যার উপর ভিত্তি করে এই রীতির প্রচলন।
|
পবিত্র শনি দেবতার শিলাখন্ড |
আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে, একদিন, প্রবল বৃষ্টি - বন্যার পরে কোথাথেকে একটি কালো পাথর খন্ড ভেসে আসে পানাসনালা নদীর তীরে। ১.৫ মিটার লম্বা এই পাথর খন্ডটিকে যখন স্থানীয় লোকেরা একটি কাঠি দিয়ে স্পর্শ করেন তখন পাথরটি থেকে রক্ত নির্গত হতে শুরু করে। এই ঘটনার পরে সেদিন রাতেই শনি দেব গ্রামের প্রধান কে স্বপ্নে দেখাদেন এবং জানান যে সেই পাথর খন্ডটি তারই অংশ। শনি দেব প্রধানকে আরো বলেন যে এবার থেকে তিনি এই গ্রামে থাকবেন এবং তার শিলা খন্ডটিকে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেন। শনি দেব গ্রামপ্রধানকে প্রতিশ্রতি দেন যে তিনি এই গ্রামকে বিপদ থেকে রক্ষা করবেন কিন্তু একটি শর্তের পরিবর্তে। তিনি জানান যে তার শিলাখন্ডকে যেন মুক্ত স্থানে কোনো দেয়াল ছাড়া রাখা হয় যাতে তিনি তার শক্তি দিয়ে গ্রামের তদারকি করতে পারেন এবং যাতে তিনি অবাধে বিচরণ করতে সক্ষম হন গ্রামের যেকোনো স্থানে । প্রধানের কথা অনুযায়ী শনি দেবতার শিলা খণ্ডটি গ্রামের মাঝখানের একটি স্থানে উন্মুক্ত অবস্থায় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং গ্রামবাসীরা সেদিন থেকে ঠিক করেন যে তারা কোনো রকম দরজা বা তালার ব্যবহার করবেননা। সেদিন থেকে এভাবেই শনি দেব অলৌকিক ভাবে গ্রামবাসীদের রক্ষা করে আসছেন। প্রতি দিন প্রায় ৪০ হাজার দর্শনার্থীরা আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শনি শিঙনাপুর শনি মন্দির দর্শন করতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন আসছে। বর্তমানে, গ্রামের অনেক গ্রামবাসী চাইছেন যে পরিবার ও মূল্যবান জিনিসের রক্ষনার্থে নিজের বাসস্থানে দরজা বা তালা লাগাতে, বিপদকালে যাতে অসহায় অবস্থায় না থাকতে হয়। অনেক গ্রামবাসীর এও ধারণা যে প্রতন্ত গ্রাম বলেই হয়তো এখানে অপরাধের পরিমান অনেক কম। সে সত্য যাই থাকুক বিশ্বাস এর কাছে তা সব সময়ে হার মানতে বাধ্য। যখন সেই বিশ্বাস নিয়মিত ভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছে প্রতিটি গ্রামবাসীকেই।
Comments